Friday, August 21, 2020

লেখাটা বছর খানেক আগের

লেখাটা বছর খানেক আগের


আমি গ্রামে এলে ঘরে বসে দিন কাটাই। ভাববেন হয়ত আমি ঘরকুনো, আসলে ব্যাপারটা তা না। ছোটবেলা থেকে শহরে যাযাবরের মত জীবন কাটিয়ে পুরো দস্তুর শহুরে না হলেও কিছুটা তো হয়েছি বটেই। তাই বলে খালি পায়ে ক্ষেতের আঁল দিয়ে হাঁটা ভুলিনি, ভুলিনি পৈতৃক সূত্রে শেখা কৃষিকাজগুলো। মানুষ হয়ত কিছুদিন শহরে বসবাস করে গ্রাম্যতা ভুলে গিয়ে শহুরে হাওয়া গায়ে লাগিয়ে ভিন্ন এক খোলস ধরণ করে ভাব নিতে চায়। পরিণামে যে রূপটি প্রতিভাত হয়, তা ঠিক কাকের গায়ে ময়ূরপুচ্ছের ন্যায়। আমি শহরে শহুরে, আর গায়ে গাঁইয়া ভাবটি বজায় রেখে চলতে পারি। আমি পানির মত, সব পাত্রেই আঁকার নিতে পারি।

ঘরে বসে থাকার কারণটি যদি বিশ্লেষণ করি, তাহলে কয়েকটি দিক আমাকে আলোচনায় টানতে হবে। সেগুলো কিছু বাহ্যিক, আর কিছু অভ্যন্তরীণ। আগে বাহ্যিক দিকগুলো আলোচনা করি।

প্রথমত, আমার শৈশব নিজ গ্রামে কাটলেও, কৈশোর কেটেছে বদ্ধ পিঞ্জিরায়। বলছি শৈশবের কথা...., তখন জীবন ছিল কিছু পরিমিত মানুষ আর পরিমিত কাজের ছকে বাঁধা। পরিমিত মানুষগুলো ছিল পরিবার কেন্দ্রিক.... বিস্তৃত পরিবার হাওয়ার কারণে শৈশবের খেলার সাথীও ছিল চাচাত ভাই,চাচাত বোন, ফুপাত বোনের ছেলে, ফুপাত বোন, আর কাছেই ছিল নানার বাড়ি। সেখানে ছিল মামাত ভাই আর কয়েকজন বোন। আমার শৈশব কেটেছে হেসে খেলে, মা'র পিটুনি খেয়ে, আর ছাগল চড়িয়ে। শৈশবে লেখাপড়ায় বিশেষ মনোযোগী ছিলাম না। মনে পড়ে, স্কুল বন্ধ হলে বইখাতা ব্যাগে গুছিয়ে যত্ন করে তুলে রেখে দিতাম। আব্বা বলতেন, একবার ফেল করলে লেখাপড়া বন্ধ করে দেবেন। ফেল আর করা হয়ে উঠেনি কখোনও। তাই আজও বইখাতা হাতে ছুটতে হয়।


কৈশোরের কথায় আসি। এই সময়ে আমি মাদরাসায় ভর্তি হই। ফলে জীবন হয়ে উঠে রোবটিকস। ওস্তাদজীর লাঠি যেদিকে হেলত, আমাদেরও সেদিকে হেলতে হত। লাঠির মাথায় আমাদের দিনের কার্য নির্ধারিত হত, বাধ্য ছিলাম মেনে নিতে। সময় প্রবাহের সাথে সাথে আমিও স্বপ্ন দেখতাম..... আমার হাতে লাঠি, সেই লাঠি দিয়ে হেলাচ্ছি দোলাচ্ছি কিছু আমারই মত জোর করে বাধ্য হওয়া ছাত্রদের।

এই সময় ছুটিতে বাড়িতে এলে টিভি দেখে আর বাটোন ফোন টিপে সময় কাটাতাম। এলাকার ছেলেদের সাথে দেখা হলে কথা হত, কুশলাদি বিনিময় পর্যন্তই। যদি তারা দল বেঁধে কোথাও যেত, আমার দেখা পেলে বলত, "বাড়িতে কয়দিন আছ? থাক, আমরা একটু অমুক যায়গায় যাচ্ছি"। তারা আমাকে সঙ্গে যাবার কথা বলত না, আমিও যেতাম না। এভাবেই দূরত্ব বাড়তে থাকে গ্রামের সমবয়সীদের সাথে।

দ্বিতীয়ত কারণটি হলো মনস্তাত্ত্বিক। একাকিত্বে ভোগা। দাখিল পাস করার পর ঢাকায় আলিমে ভর্তি হওয়ার পর জীবনের গতি একটু ভিন্ন পথে মোড় নেয়। ঠিক ইউটার্ণ যাকে বলে। মাদ্রাসায় শেষ বেঞ্চে বসে আপন মনে ক্লাস করতাম, পাশে বসা বন্ধুটিকে জিজ্ঞেসও করতাম না, " তোমার নাম কী?" কেউ জিজ্ঞেস করলে উত্তর দিতাম শুধু। এভাবে কিছুদিন চলার পর রামায়ণ সূত্রে ক্লাসে আমার আত্মপ্রকাশ ঘটে। সব ছাত্রের মনোযোগ আমি রাজা দশরথের তিন স্ত্রীর নাম বলে আমার দিকে ফিরিয়ে আনি। আস্তে আস্তে আমি সামনের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করি। ক্লাসের মাঝ বরাবর এসে থিতু হই,এবং ক্লাসের শেষ দিন পর্যন্ত যায়গাটা বহাল ছিল। ঢাকা থেকে বাড়িতে এলে সময় কাটত চাচাত ভাইয়ের সাথে, এবং তার কিছু সহপাঠী আসত। যারা কিছুটা সময় একসাথে কাটাতে ভালোবাসতো। তখন আমরা লুঙ্গি পড়ে গ্রামের এ মাথা ও মাথা ঘুরে বেড়াতাম। এখানে উল্লেখ্য যে, আমরা কেউই সিগারেটের স-ও ছুঁয়ে দেখিনি কখোনও। 


আলিম পাস করার পর গ্রামের যে কয়জনের সাথে সখ্যতা ছিল... ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। চাচাত ভাই ঢাকায় চলে যায়,কাজে। তার সহপাঠী একজন নৌবাহিনীতে চাকরি পায়, আরেকজন টঙ্গী কলেজে ভর্তি হয়ে ঢাকা চলে যায়, আমি ঢাকা থেকে ফিরে এসে রংপুরে থিতু হই। গ্রামে আর এমন কেউ থাকল না যে, একসাথে একটু সময় কাটানো যায়। এজন্য ঘরে বসে টিভি দেখা,আর বাটন ফোনে ফেসবুকিং করাই প্রধান কাজ হয়ে উঠে বাড়িতে এলে।

মনমত সঙ্গী না পেলে আর যাই হোক ঘুরে মজা পাওয়া যায় না। আমার এলাকার মোস্ট সিনিয়ররা বাচ্চাদের সাথেও সময় কাটাতে পারে, আমি পারিনা। তাই বাড়িতে এলে আমাকে একাকীত্ব গ্রাস করে নেয়, তাই যে কয়টি দিন থাকি ঘরে বসে পরিবারের সাথেই সময়টা কাটে।

এবার আসি অভ্যন্তরিন কারণগুলোয়...
প্রথমত, গ্রামের যেই ছেলেটির সাথে শৈশব জড়িয়ে আছে, অনেক স্মৃতি আছে, দেখা হলে মন খুলে যার সাথে কথা বলা যায়.... তাকে জড়িয়ে ধরলে যদি তার মুখ থেকে মাদকের গন্ধ আসে, তখন আমার করার কিছুই থাকে না। দূরত্ব বাড়তে থাকে। এই দূরত্ব থেকে যদি বিচ্ছেদ হয়, তবুও আমার আপত্তি নেই। কারণ, তার সাথে সম্পর্ক রখতে গিয়ে যদি আমি মাদকের প্রতি প্রভাবিত হয়ে যাই? বলা তো যায় না, ঘটে যেতে কতক্ষণ? 

আমি সিগারেট ছুঁই না, ধোয়ার গন্ধও সহ্য করতে পারি না। এই ব্যাপারে একটি গল্প বলা যেতে পারে...
" বিলে আমরা কয়েকজন বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আমাদের এলাকার একটি ছেলে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে আমাদের কাছে এলো। ছেলেটি আমাদের অনেক জুনিয়র। আমি তাকে বললাম, হয় সিগারেট ফেলে দাও, অথবা দূরে গিয়ে শেষ করে এসো। সে বলল, প্রবলেম কী? বললাম, আমার গন্ধ সহ্য হয় না। তখন সে বলেছিল, এটা কি পুরুষ মানুষের মত কথা বললেন? 

সেদিন আমি বুঝিনি, আজও বুঝিনা সিগারেটের গন্ধ সহ্য করতে না পরা, সিগারেট না খাওয়ার মাঝে কতটুকু কাপুরুষতা লুকিয়ে আছে!"

শুধু সিগারেট নয়। সিগারেট তো মামুলী বিষয়। আমার গ্রামের ছোট-বড় অধিকাংশ সবাই প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে মাদক গ্রহণ ও সেবনের সাথে সম্পৃক্ত। আমি একজন সচেতন মানুষ হিসেবে অবশ্যই চাইব না, আমি এমন কারো সাথে সময় কাটাই, যে আমার জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে অনায়াসে। 

এখানে প্রশ্ন আসতে পারে, আমি কেন তাদের সচেতন করছি না? আরে ভাই, সচেতনতামূলক কথা তারা আমার কাছ থেকে শুনবে কেন? আমি অমুকের বেটা, কোন চ্যাটের বাল হয়ে গেছি!আর তারা কি আমার বাপের টাকায় সিগারেট খায় নাকি? তাদের মনমানসিকতা এমন।

দ্বিতীয়ত...আমি অনেকদিন পর বাড়িতে যাব, তখন অবশ্যই চাইব না কেউ আমার সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করুক। কেউ যখন আমার সাথে কথা বলবে, তার কথার দশটার মধ্যে পাঁচটিই যখন গালি থাকবে, তখন তার মত-রা ছাড়া অন্য কেউ সহজে কথা বলতে চাইবে না। উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিস্কার বোঝা যাবে। ধরুন, বাড়িতে আসার দুইদিন পর একজনের সাথে আমার দেখা, তার সৌজন্যমূলক কথগুলো এমন "এই চুতমারানি, দুইদিন আগে আসা মারাইছো আমাকে তো একবার কলও দেয়া চোদাওনাই,। " এমন। তখন তার এমন অভ্যর্থনার জবাব কী হবে... আমি জানিনা।

তৃতীয়ত.... বন্ধু-বান্ধবের মাঝে আলোচনার বিষয় একটি, তা হলো মেয়ে। এলাকায় কোন লোকের মেয়ে একটু বাড়ন্ত। সেই মেয়ের পিছে কয়জন লেগেছে, বাড়ির পাশে কারা ঘুরঘুর করে। কে কয়টা প্রেম করে, কয়টাকে খাইছে,কীভাবে খেল।আশেপাশের এলাকায় কোনো মেয়ে আছে কি না.... এসবই আলোচনার মূল টপিক। এর বাইরে কোনো আলোচনা নেই।
আমাকে প্রশ্ন করা হয়, "ক্যাম্পাসে তো মেয়ের অভাব নেই। কয়টা রিলেশন করো, কী কী করলা ইত্যাদি। এসব শুনলেই মন বিষিয়ে যায়।

তাই নিজের মত ঘরে বসে গোপাল ভাঁড় দেখি। ছোট বোনের সাথে ছোট্ট হয়ে বাড়ির বাইরে যাইনা। ইচ্ছেও করে না।