Tuesday, July 28, 2020

ছোটগল্প দোলনচাঁপা এবং মেঘলা দিন

ছোটগল্প
দোলনচাঁপা এবং মেঘলা দিন
আতিয়ার রহমান


(১)

যখনই কোনো কাজে বা প্রয়োজনে ঢাকায় যাওয়ার কথা ওঠে তখনই প্রেমেন্দ্র মিত্রের একটি ছোটগল্পের কিছু লাইনের কথা মনে পড়ে। অনেকদিন প্রেমেন্দ্র মিত্রের গল্প পড়া হয় না বলে ছত্রগুলো হুবহু মনে নেই, কিন্তু সেগুলোর সারসংক্ষেপ এই যে- শহরে অনেক ধূলোবালি, বাতাসে যেন বিষ, আমাদের প্রাপ্তিগুলোও যেন বিষিয়ে যায় এই শহরের যান্ত্রিক কোলাহলে।

আবার প্রায়ই তিলোত্তমা ঢাকাকে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ভাষায় মনোরম মনোটোনাস শহর মনে হয়। এখানে অনেক ভীড় কিন্তু সেই ভীড় যেন খুব নিঃসঙ্গ, সবাই আছে, আবার মনে হয় কোথাও কেউ নেই।

যা হোক চাকরিসূত্রে ঢাকা ত্যাগ করেছি দু'বছর হল, ঢাকায় থেকেছি প্রায় নয় বছর, তারপরও কেন জানি নিজেকে কখনো এই যান্ত্রিক হাওয়ায় খাপ খাওয়াতে পারিনি। সব সময় মনে হত কখন যে পালাবো। কিন্তু পালিয়ে আর যাবো কোথায়? ঘুরে ফিরে আবারও আসতে হয়।

যা হোক। ঢাকায় আমার বেশকিছু আত্মীয় আছে। তাদের সাথে আমার তেমন যোগাযোগ না হলেও আমার আম্মুর সাথে তাদের প্রায়ই যোগাযোগ হয়। তেমনি এক আত্নীয় একদিন সকালে আমার আম্মুকে ফোন করে জানালো যে তাদের ছেলের বিয়ে ঠিক হয়েছে। তাই তিনি আমাদের অনুরোধ করলেন আমরা যেন সবাই অনুষ্ঠানের ২ দিন আগেই ঢাকায় পৌঁছে যাই। আমার যাওয়ার কোনো ইচ্ছাই ছিল না।

কিন্তু আমার মা এবং ছোট বোনের আনন্দ-উল্লাস দেখে নিজেকে কঠোর হাতে দমন করলাম। ভাবলাম ওরা দেশের বাইরে তেমন যায় না, আজ যখন একটি খুশির মুহূর্ত এলো তখন তা উপভোগ করুক, আমি বাঁধ সাধলে বড় অন্যায় হবে। আমি রাজি হয়ে গেলাম। আমার বাবা একজন ব্যাংকার, তিনি ছুটি পেলেন না, তাই তিনি যেতে পারলেন না। তবে তিনি আমাদের ঢাকা যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দিলেন। তো যথাসময়ে আমরা ঢাকার উদ্দেশ্য রওনা হলাম।

(২)
রাত ১০ টায় কুড়িগ্রাম থেকে বাস ছেড়ে দিয়েছিলো। আমরা ঢাকায় পৌঁছি ভোর ৬ টায়। সিএনজি নিয়ে আমরা সোজা চলে যাই মিরপুর ১০ এ। ঢাকার আত্নীয় সম্পর্কে আমার নানী হন, এ জন্য সেই বাড়িটিকে ঢাকার নানী বাড়ি বলেই জানতাম ছোটবেলা থেকেই। আমি কোনোদিন সেখানে যাইনি, তাই বড় মামা ফোনে বলে দিয়েছিলো মিরপুর ১০ এর গোলচক্করে তিনি অপেক্ষা করবেন।

ঢাকায় নেমেই আমি মামাকে জানিয়ে দিই, তিনি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন বলে জানালেন। গোলচক্করে পৌঁছেই মামাকে আবার ফোন দিলাম, কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি চলে এলেন। এরপর আমরা রিকশা যোগে নানী বাড়িতে গেলাম। প্রকাণ্ড অট্টালিকা, বিয়ে উপলক্ষে গোটা বাড়িতেই লাইটিং করা হয়েছে। ঢাকা শহরের টাকাওয়ালা মানুষ কি না করতে পারে? বাড়িতে ঢুকে মামা ড্রইং রুমে আমাদের বসিয়ে দিয়ে বললেন---

-একটু বসো, অহনি আইতাছি।'
এ কথা বলে তিনি ভেতরে চলে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে বড় মামি আর তার বড় ছেলে ড্রইং রুমে এলেন। বড় মামি এসেই বললেন---
-এই যে আইসা পড়ছো তোমরা?
আমার আম্মুকে বললেন---
-আপা কেমন আছেন?
আম্মু বললো---
-এইতো ভালো, আপনি কেমন আছেন? শরীর এত শুকনা দেখাইতেছে কেন? ছেলের বিয়া দিতেছেন মেয়ের তো আর না। খুব টেনশন নাকি?
মামী হেসে ফেললেন, বললেন---

-আরে আপা ছেলের বিয়াতেই তো টেনশন বেশি, পরশু বউ আসবো, বউ তো ছেলেরে পর কইরা দিবো, হেই টেনশন তো লাইগাই আছে।
আম্মুও একটু ফোঁড়ন কাটলো। এরপর মামী আমার দিকে চেয়ে বললেন---
-তোমার মিয়া বিচার আছে।
সেই মুহূর্তে নানী এসে পড়লেন, দূর থেকে দাঁড়িয়েই বলতে শুরু করলেন---
-কার বিচার হবে? এ্যা?
মামী বললেন---

-আর কার? আপনার এই ভার্সিটি পড়ুয়া নাতীর।
নানী কাছে এসে বললেন---
-নানা ভাই ভালো আছো?
-জ্বী নানী ভালো আছি, আপনার শরীর এখন কেমন?

-আর শরীর! এই ভালো তো এই খারাপ। কখন যে মইরে যাবো ঠিক নাই।
আমি চুপ করে রইলাম। তিনি বললেন---
-অনেক কথা হইবো, তোমরা আগে হাত-মুখ ধুইয়া নাও।
বড় মামা আমাকে বললেন---

বাবা তুমি আসো আমার সাথে।
আম্মু আর ছোটবোন নানীর সাথে তার রুমে চলে গেলো। এই প্রথম মনে হল ঢাকার মানুষেরা হয়ত অত নিষ্ঠুর নয় যতটা আমি ভাবতাম বা ভাবি।

(৩)

যথারীতি শুভক্ষণ চলে এলো। কন্যার বাড়ি মালিবাগ। মালিবাগের একটি কমিউনিটি সেন্টারে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো। আমরা বিকেল পাঁচটায় বরযাত্রী হয়ে সেখানে পৌঁছাই। কিছুক্ষণ পর নববধূকে নিয়ে হাজির হল তার মা-বাবা এবং অন্যান্য আত্মীয়েরা। ৭ টার দিকে বিয়ে পড়ানো শুরু হয়। তার পর পরই শুরু হয় মহাভোজ।

দেখে মনে হল রাজকন্যার বিয়ে। অবশ্য প্রত্যকটি মেয়েই তার বাবার কাছে রাজকন্যার মতই। প্রতিটা ছেলে তার মায়ের কাছে খুব আদরের হলেও তাকে রাজকুমার বলে কি? জানা নেই। ভোজন পর্বে পরিচয় হয় নীলার সাথে। নীলা আমার মামাত ভাই এর দূরের সম্পর্কের চাচাত বোন। নানী বাড়িতে আসা অবধি আমি নীলাকে দেখিনি। সে এসে সালাম দিয়ে বললো---
ভাইয়া আপনি আলফায ভাইয়ার ফুপাত ভাই তাই না? কুড়িগ্রাম থেকে এসেছেন।

-জ্বী, আপনাকে তো চিনলাম না।-
-না চেনারই কথা, এর আগে তো দেখেন নি। আমি গতকাল আপনার মায়ের সাথে কথা বলেছি, আর আপনার নানী অর্থাৎ আমার দাদীর কাছে আপনাদের কথা শুনলাম। আজ এখানে এসে আপনাকে আপনার মায়ের সাথে দেখে বুঝলাম আপনি আলফায ভাইয়ার ভাই।
আমি মৃদু হেসে জিজ্ঞেস করলাম---
-আপনার নাম?
-আমি নীল।

-আমি কাওসার। তো আপনাদের বাড়ি কোথায়?
-ভাইয়া আমি আপনার থেকে ছোট, আমাকে তুমি করে বলবেন। আমরা উত্তরা ১০ নম্বর সেক্টরে থাকি।
নীলার সাথে বেশ কিছুক্ষণ কথা হয়েছিল। ভালো লেগেছে ওর কথা শুনে। মার্জিত রুচির মনে হল ওকে। এরপর সব অনুষ্ঠান চুকে গেলে রাত ১০ টায় আমরা বরযাত্রী নববধূকে নিয়ে মিরপুরের দিকে রওনা হই।

(৪)

দেখতে দেখতে বিয়ের সকল পর্ব চুকে গেলো। আমাদের উদ্দেশ্যও সফল হল। তাই আর ঢাকায় থাকতে ইচ্ছা করছিলো না। আমার নিভৃত শহরটির এককোণে আমার নিরিবিলি ঘর, আমার ঘরের জানালা, বিছানা, টেবিল, উঠোনে লাগানো আমার গোলাপ ফুলের চারা, আমার প্রিয় কবুতরগুলো সবকিছুকে মিস করছিলাম। আম্মুকে বললাম---
-বিয়ে তো শেষ এখন চলো ফেরা যাক।

-ঠিক আছে তোমার নানীর সাথে কথা বলে দেখি।
সন্ধ্যায় আম্মু নানীকে ফেরার কথা বলে। নানী আমাকে ডেকে পাঠান। আমি নানীর ঘরে যেতেই নানী বলে উঠলেন---
কি রে! বাড়ি যাওয়ার লাইগা এত অস্থির হইছস ক্যান? বউ আছে নাকি নাকি বাড়িত?
হেসে বললাম-

বউ আর কোথায়? অনেকদিন তো থাকলাম এবার তো যাওয়া দরকার।
নানী আরো ৩-৪ দিন থাকার কথা বললেন। আমি বললাম---
-৩-৪ দিন! এতদিন না নানী! আচ্ছা আপনি যখন বলছেন তখন আমরা আর ২ দিন থাকি, তাহলে আমরা আগামি পরশু যাবো।

নানী খুশি হলেন না, আরো কিছু বলতে চাইছিলেন, মামা হঠাৎ এসে নানীকে বললেন---
-এই যে জোর করতাছো, এমন করলে তো এরা আর আসবেই না।
মামার উপস্থিতি আমাকে শান্তি দিলো। ভাবলাম দুটো দিন এমনিই চলে যাবে। নানীকে বললাম---
-নানী আপনি মন খারাপ করিয়েন না, আমরা আবার আসবো।
নানী একটু হেসে বললেন-'আইচ্ছা।'

সকাল বেলাটা পরিচ্ছন্ন ছিলো, বেলা বাড়ার সাথে সাথে আকাশে মেঘ করতে লাগলো। দুপুর ১২ টা নাগাদ সবকিছু তোলপাড় করে বৃষ্টি এলো পুরো শহরে। বৃষ্টির দিনে যে কারোরই মন আনমনা হতে বাধ্য। একটা চেয়ার টেনে বেলকনিতে বসলাম। বৃষ্টির চাদরে ঢেকে ছিলো চারপাশ। শুনতে পেলাম পাশের একটি দালান থেকে ভেসে আসছে-'আমার সারাটা দিন মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি তোমাকে দিলাম।' এরপর বাকি অংশ বৃষ্টির শব্দে আর শোনা গেলো না।

তবে সে সবকিছু ছাঁপিয়ে মনের অন্দরে শুধু একটি কথাই ধ্বনিত হতে লাগলো-'শূন্য মন্দির মোর।' ভেসে যাচ্ছিলাম স্মৃতির আঙিনায়। বন্ধুদের কথা মনে পড়ছিলো, আর বুকটা মোচড় দিয়ে উঠছিলো। কতগুলো বছর আমরা একসাথে ছিলাম! অথচ আজ কে কোথায়! মনে পড়ে গেলো আলোকিত সেই দিনগুলোর কথা।

আর মনে পড়লো দুটি চঞ্চল চোখের কথা, একটি মুখ আর তপ্ত কিছু দীর্ঘশ্বাস। মনের অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে এলো-'তোমার আমার মাঝে আজি সপ্ত পারাবার।' হঠাৎ সবকিছু বিদীর্ণ করে একটি আওয়াজ কানে এলো, মামী এসে বললেন---
এইখানে বইসা আছো? আসো খাবার রেডি, খাইয়া নেও।
মামীর সাথে ভেতরে চলে গেলাম।

(৫)

দুপুরের খাবার পর বাড়ির সবাই দিবানিদ্রার জন্য যে যার ঘরে চলে গেলো। বৃষ্টিটাও ধরে এলো। আমার ঘরে থাকতে ইচ্ছা করছিলো না। সিদ্ধান্ত নিলাম একবার ক্যাম্পাস থেকে ঘুরে আসি। রেডি হয়ে মাকে জানিয়ে বের হয়ে গেলাম। চিরচেনা ক্যাম্পাসে গিয়ে স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো ঘুরে দেখতে লাগলাম। কত ছেলে-মেয়ে ওখানে, কত আড্ডা, কত হৈচৈ। এক সময় আমাদেরও দিন ছিল, এই ভীড় এই হাসি-আড্ডায় হারিয়ে যাওয়া মুখগুলোই যেন দেখতে পাচ্ছিলাম।
হঠাৎ কি মনে হল ইচ্ছা হল ধানমন্ডি লেক থেকে একবার ঘুরে আসি।

যার জন্য আগে সেখানে যেতাম সে তো আজ নেই, স্মৃতির পাতায় সে অম্লান, আর অম্লান হয়ে আছে আমাদের পূর্বেকার সেই মিলনস্থল। আর দেরি না করে লেকের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। বিকেল ৫ টার দিকে ধানমন্ডি লেকে পৌঁছলাম। দেখলাম সবকিছু আগের মতই আছে, শুধু মানুষের ভীড় বেড়ে গেছে এই যা।

লোকাল বাস থেকে নেমে সেই স্থানটির দিকে হাঁটা শুরু করলাম যেখানে সূচনা হয়েছিলো নতুন একটি সম্পর্কের, নতুন স্বপ্নগুলো যেখানে পাখা মেলার অপেক্ষায় ছিলো। লেকের পাশে বেশকিছু বসার জায়গা আছে, আমরা যেখানে বসতাম সেখানে গিয়ে দেখলাম জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে, একদিকে একজন মহিলা বসে আছে আর অন্য দিকে একটি জুটি গল্পে মশগুল।

মহিলাটি যে জায়গায় বসেছিলো তারপাশে সামান্য দূরত্বে গিয়ে বসলাম। স্মৃতির ট্রাফিক জ্যাম পুরো মস্তিষ্কে যেন কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে দিলো। একমনে লেকের ঘোলাটে জলের দিকে তাকিয়েছিলাম। আচমকা একটি পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনে বুকটা ধড়াস করে উঠলো৷ কাকতালীয় ঘটনা মানুষের জীবনে ঘটে, আমার সাথে এমন করে ঘটবে তা কল্পনাও করিনি। দ্বিতীয়বার শুনলাম---

কাওসার শুনছো?
পাশ ফিরে দেখি দোলা বসে আছে।স্মৃতিকাতরতা এতই প্রবল ছিল যে এসে খেয়ালই করিনি যে দোলা বসে ছিল পাশে। ঘটনার আকস্মিকতায় এমনভাবে ভড়কে গিয়েছিলাম যে কি বলবো তা বুঝতো পারছিলাম না। দোলাই আবার প্রশ্ন করলো---

চিনতে পারছো না?
আমি বললাম---
-কি যে বলো? কেমন আছো?
-এই আছি? তোমার কি খবর?
-ভালো আছি।

এরপর কি বলা উচিত তা ভেবে পাচ্ছিলাম না, হয়ত দোলাও।
প্রশ্বাসের খুব কাছাকাছি থেকেও বিচ্ছেদের যোজন দূরত্ব আমাদের নির্বাক করে দিয়েছিলো। সেই দিন আর নেই, যখন কারো হাত ছুঁয়ে থাকত কারো হাতের পর, আদুরে আহ্লাদে কারো মাথা ঢলে পড়তো কারো নিরাপদ কাঁধে। যখন কারো শরীরের গন্ধে ফিকে হয়ে যেত বসন্তের হাওয়া। যখন একটি দিন কথা না হলে কেউ অভিমান করে গাল ফুলিয়ে রাখতো। এগুলো এখন সুদূর অতীত, বেঁকে গেছে দুটি পথ।

আমরা চলতে চলতে মিশে গেছি জীবনের অসীম কোলাহলে। আমাদের চিরচেনা পথে আমাদের পদরেখা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। অতীত স্মৃতি অনন্ত রাত্রির মত জেগে থাকে। ক্ষত যা ছিল তা আর নেই, রয়ে গেছে শুধু দাগ। সেগুলো ব্যথা দেয় না, তবে মনে করিয়ে দেয় আমাদেরও একটা সময় ছিল যখন কথা স্রোতধারায় আমরা ভেসে যেতাম মিলন সাগরে, অথচ আজ কি বলতে হবে তাই ভেবে সারা হয়ে যাচ্ছি।

আমিই নিরবতা ভেঙে বললাম---
-দোলা এখন কোথায় আছো? কি করছো?
-এখানেই একটা স্কুলে শিক্ষকতা করছি।
-খুবই ভালো কথা।

এরপর আবারো নিরবতা নেমে এলো। হঠাৎ দোলা প্রশ্ন করলো---
-হঠাৎ এখানে কি মনে করে এলে?
একটু সংকোচের সাথে বললাম---
-নস্টালজিক হয়ে পড়েছিলাম, তাই ভাবলাম একবার ঘুরে আসি।
-এসে আমার মুখোমুখি হবে এটা হয়ত আশা করোনি। তুমি তো আমার সামনে আর আসবেনা বলেছিলে।
আমি বললাম---

-নিয়তি মানুষকে কোথায় নিয়ে যায় তা তো বোঝা মুশকিল। আমি আগে ভাবতাম কখনো প্রেমেই পড়বো না, কিন্তু প্রেমে তো পড়েছিলাম, আবার ভেবেছিলাম তোমার হাতটা কখনো ছাড়বো না, কিন্তু পারিনি, ছেড়ে দিতে হল। মুখোমুখি হতে চাইনি কষ্ট হবে বলে, কিন্তু তাও তো হল না, দেখা তো হয়েই গেলো।
দোলা একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো---

-এখন কষ্ট হচ্ছে না?
আমি মৃদু হেসে পাল্টা তাকেই জিজ্ঞেস করলাম---
তোমার হচ্ছে কি?
দোলা এর কোনো জবাব না দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করলো---
-বিয়ে করেছো?
-না, এখনই না আর কিছুদিন যাক।

এমন সময় দেখলাম সামান্য দূরে কয়েকটি ছেলে একটা গান গাইছে, গানের এক জায়গায় বলছে-"শূন্যে ভাসি রাত্রি এখনো গুনি, তোমার আমার নৌকা বাওয়ার শব্দ এখনো শুনি।" গানটি আগে শুনিনি, কিন্তু কথাগুলো বুকে বিঁধলো যেন। দোলাকে বললাম---
-তুমি বিয়ে করেছো?
সেও না সূচক জবাব দিলো। আমি বললাম---

-মনে আছে দোলা এমনই এক শ্রাবণের দিনে এখানে বসে আমরা ঝগড়া করছিলাম, তুমি সেদিন প্রচন্ডরকম ক্ষেপে ছিলে।
এইবার দোলার মুখে হাসি ফুটে উঠলো, বললো---
-হুম, মনে আছে।
এমন সময় একজন ফুলওয়ালা পাশ দিয়ে যাচ্ছিলো, ওর হাতে দেখলাম দোলনচাঁপা ফুল। ডাক দিলাম। লোকটি কাছে আসতেই বললাম---

-এই ফুল কত করে?
-একটা ডাটা ১০ টাকা।
একটি ডাটা কিনে দোলার হাতে দিলাম। দোলা খুশি হল।
সে বললো---

-তোমার মনে আছে আমার পছন্দের কথা?
-খুব মনে আছে। আগে তো দিতে পারিনি, তাই আজ দিলাম।
দোলা এক মুহূর্ত আমার দিকে তাকিয়ে রইলো, আমি ওর দিকে তাকাতে পারছিলাম না, কিন্তু ঠিকই অনুভব করছিলাম তার সিগ্ধদৃষ্টি আমার দিকে পড়ে আছে।

বেলা পড়ে এলো, শ্রাবণের মেঘলা দিনে বেলা যেন দ্রুত শেষ হয়। অন্ধকার নামছিলো। অন্ধকারের ক্রুর কালো পটে দৃষ্টি মেলে বসেছিলাম। আর মনে হাজারো প্রশ্ন অর্থহীন জিজ্ঞাসায় ভীড় করছিলো। বুকের ভেতরটা কে যেন চেপে ধরেছিলো। চারিদিকে খোলা পরিবেশ, হাওয়ার অভাব ছিল না, কিন্তু আমি যেন দম নিতে পারছিলাম না। মনে হল আর নয়, এখন পালাতে হবে। দোলাকে বললাম---

-দোলা অনেক দেরি হয়ে গেছে, যেতে হবে। চলো সামনের দিকে যাই।
দোলা বললো---
-না, আমি আর একটু বসবো।
আমি বললাম---

-আচ্ছা আমি যাই তবে, ভালো থেকো। দোলা মাথা নেড়ে একটু শুধু হাসলো। আমি লেক ছেড়ে সামনে এগোতে লাগলাম। একবার মনে হল ফিরে যাই আবার। কিন্তু অনেক কষ্টে নিজেকে সংবরণ করলাম। ফিরে তাকানোর সাহস আর হল না। মনে হচ্ছিলো হয়ত অশ্রুসিক্ত দুটি নয়ন আমার পথের দিকে চেয়ে আছে অপলকভাবে।

লেক পেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলাম। শুনতে পেলাম পাশে একটি মনোহারি দোকান থেকে গান ভেসে আসছে-"দেখবে আমাদের ভালোবাসা হয়ে গেছে কখন যেন পদ্মপাতার জল।" উপরে চেয়ে দেখলাম আকাশে মেঘ জমছে, হয়ত এখনই বৃষ্টি নামবে। দ্রুত ধানমন্ডি থেকে বের হয়ে মিরপুরের বাস ধরে যেতে লাগলাম নানী বাড়ির দিকে।

(৬)
বাড়ি ফিরতে ফিরতে রাত ৮ টা বেজে গেলো। বাড়িতে ঢুকতেই মা জিজ্ঞেস করলো এত দেরি হল কেন। দোলার কথা বাদ দিয়ে বাকি যা হয়েছে তা মাকে বললাম। হঠাৎ আমার ছোটবোন এসে বললো---
-ভাইয়া মিরপুর ১০ এর গোলচক্করে একটা মার্কেট আছে ওখানে যাওয়া লাগবে। কিছু জিনিস কিনবো।
যেই কথা সেই কাজ। বোনকে নিয়ে মার্কেটে গেলাম। বেশকিছু কেনাকাটা করার পর আমরা মার্কেট থেকে বের হলাম। কিছুদূর হাঁটতেই নীলার সাথে দেখা হয়ে গেলো। আমাদের দেখে নীলা বললো---

-আরে কাওসার ভাইয়া এখানে কি করছেন?
-এই যে দেখো কিছু শপিং করলো সাদিকা।
-কার জন্য শপিং?
সাদিকা বললো-
-আমার জন্য।

নীলা আমার দিকে চেয়ে বললো
-আপনি কিছু কেনেননি?
-না, আপাতত এখন আর কিছু প্রয়োজন নেই।
-আর কোনো কাজ আছে?
-না, এখন ফ্রি।

-ঠিক আছে, তো চলেন সবাই মিলে কফি খাওয়া যাক।
নীলা সাদিকাকে জিজ্ঞেস করলো---
-সাদিকা কফি চলে তো?
সাদিকা একটু ঠাট্টা করে বললো---
চলে না, দৌড়ায়।

ওর কথা শুনে আমরা হো হো করে হেসে উঠলাম।
মার্কেট লাগোয়া একটি ফাস্টফুডের দোকান ছিল, ওখান থেকে কফি খেয়ে আমরা বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। হঠাৎ নীলা বললো---

-ভাইয়া একটু দাঁড়ান।
আমরা রাস্তার একপাশে দাঁড়ালাম। নীলার হাতে একটি শপিং ব্যাগ ছিল। সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একতোড়া দোলনচাঁপা। মনটা আবার বিষিয়ে গেলো। নীলা ফুলের তোড়াটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো---
-এটা আপনার জন্য।

আমি তোড়াটা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অকস্মাৎ মনে হল দোলা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। যে শূন্যতাকে তাড়ানোর চেষ্টা করেছি সেটি যেন আরো ঘন হয়ে এলো। আর মনের ভেতর বাজতে লাগলো-"শূন্য ছিল নিতল দীঘির শীতল কালো জল/কেন তুমি ফুটলে সেথা ব্যথার নীলোৎপল?" নীলা কিছু বলছিলো কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাইনি। নীলার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম। একটা ঝাকুনি দিয়ে সাদিকা আমার চেতনা ফিরিয়ে আনলো। নীলা বললো-

-দোলনচাঁপা পছন্দ করেন না বুঝি?
-না না তা নয়।
-তবে হুট করে অমন স্ট্যাচু হয়ে গেলেন কেন?
-না তেমন কিছু না।
নীলা আবার বললো---

-দোলনচাঁপা আমার প্রিয় ফুল। আমি কিছুদিন আগে আমাদের বাড়িতে টবে লাগিয়েছি।
আমি একটু মৃদু হাসলাম। পর মুহূর্তেই একটা দমকা হাওয়া এলো। স্বস্তিদায়ক একটু হাওয়ার পরশে বুকের বা পাশের চিনচিনে ব্যথাটা একটু কমলো যেন। আকাশে তাকিয়ে দেখি ঘন মেঘ অনেকটাই কেটে গেছে। মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে অস্পষ্ট চাঁদ। নীলা বললো---

-বাড়ির রাস্তা তো বেশিদূর না, চলেন গল্প করতে করতে হেঁটেই চলে যাই, কি বলেন?
আমি সায় দিয়ে বললাম-
-চলো তবে।

(আতিয়ার রহমান; ১৯ থেকে ২২ নভেম্বর, ২০১৯)