একজন শিক্ষকঃ স্বপ্নের ফেরিওয়ালা।
............... ............... ............... ...............
আমার জীবনে কয়েকজন শিক্ষক দেখেছি, সারাজীবন যারা শ্রেণীকক্ষের প্রতি মোহিত। তাঁদের ধ্যান, জ্ঞান, চিন্তা, চেতনা হলো শ্রেণীকক্ষে বসে থাকা ভবিষ্যত প্রজন্মের মাঝে সুশিক্ষা ও মনুষ্যত্বের বীজ বপন করা। শিক্ষকতার জীবনে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর মাঝে যদি একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে, তবে শিক্ষক মনে করেন তাঁর জীবন সার্থক হয়েছে।
বহুদিন শিক্ষকতা পেশায় কর্মরত থাকার পর যখন একজন শিক্ষক অবসরে যান, তিনি যদি প্রকৃত শিক্ষক হন... তবে বার বার শ্রেণীকক্ষ সেই শিক্ষককে টেনে নেয়। "প্রকৃত শিক্ষক" কথাটি বলার কারণ হলো যে, "অনেক BCS ক্যাডার শিক্ষক দেখেছি, যারা এক হাজার টাকার লোভ সামলাতে পারেন না। তারা আসলে কোন পর্যায়ের শিক্ষক আমি জানিনা।" শিক্ষক তাঁরাই, যারা অমানুষকে মানুষ, বিবেকহীনকে বিবেকবান, চরিত্রহীনকে চরিত্রবান হিসেবে গড়ে তুলতে পারেন। এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে শেখার আগ্রহ সৃষ্টি করতে পারেন।
এমনই একজন শিক্ষক, যিনি কর্মজীবনে কারমাইকেল কলেজ, পাবনা এ্যাডওয়ার্ড কলেজ, সরকারি আজিজুল হক কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ, সর্বশেষ নওগাঁ সরকারি কলেজের অবসর প্রাপ্ত অধ্যক্ষ ড. মোস্তাফিজার রহমান স্যার। যখন এদেশের শিক্ষার্থীরা স্বপ্ন দেখতে ভয় পায়, তখন এই প্রতিকুল অবস্থায় স্যার স্বপ্নের ফেরিওয়ালা হয়ে বৃদ্ধ বয়সে আজও ছুটে বেড়াচ্ছেন বিভিন্ন শ্রেণীকক্ষে।
কারমাইকেল কলেজের বাংলা বিভাগের শ্রেণীকক্ষে স্যারের সাথে আমার প্রথম আলাপ। স্যারের বক্তব্যর জোস সেদিন আমাদের প্রাণীত করেছিলো।
কারমাইকেল কলেজের কর্ম জীবনে স্যার গোপাল লাল হোস্টেল(জি.এল. হোস্টেল)এর ভারপ্রাপ্ত তত্বাবধায়ক শিক্ষক, এবং তত্বাবধায়ক শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বহুদিন।
আমি জি. এল. হোস্টেলে থাকি শুনে স্যার খুশি হয়ে বলেছিলেন, তিনি হোস্টেলে সবার সাথে দেখা করতে আসবেন, স্মৃতিচারণ করবেন। আমি যেন স্যারের সাথে থাকি।
রাতে আমাদের ভাইস প্রিন্সিপাল ড. আমজাদ হোসেন স্যারের সাথে স্যার এসেছিলেন। তিনি কারমাইকেল তথা রংপুরে এসেছেন শুনে তাঁর সাবেক প্রিয় ছাত্ররা পাগলের মত দেখা করতে ছুটে এসেছিলেন।
সেদিন সকলের সামনে স্যার আমাকে বললেন, তুমি আজ এই আয়োজনের সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করো। উপস্থাপনার অভিজ্ঞতা থাকা সত্বেও স্যার ও তাঁর ছাত্রদের সামনে দু'লাইন নির্ভুল বলতে পারিনি। স্যার হয়ত আমার ব্যাপারটি বুঝতে পেরেছিলেন, তাই আমাকে আর তেমন কিছু বলতে হয়নি। স্যার উঠে জি.এল. হোস্টেলে অবস্থানরত ছাত্রদের উদ্দেশ্যে প্রায় তিন ঘন্টা বক্তৃতা করলেন! অনেক স্মৃতিচারণ, আবেগে উদ্বেলীত অনুভূতি, জ্ঞানগর্ভ মূলক আলোচনা করে সকল ছাত্রদের মুখের কথা স্যার কেড়ে নিয়েছিলেন সেদিন। ছাত্রদের অনুভূতি প্রকাশ পর্বে ছাত্ররা বলেছিলো, "ভাব আছে, ভাষা নেই"। সেদিন হোস্টেলের সকল ছাত্রদের বুকে নবস্বপ্নের বীজ বপন করে স্যার ফিরে গিয়েছিলেন।
এরপর স্যারের সাথে আবার দেখা হলো ১৬ নভেম্বর, কারমাইকেল নাট্য-সাহিত্য সংসদ (কানাসাস) এর প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে। বহুবছর পর স্যার বাংলা মঞ্চে উঠে সকলের উদ্দেশ্যে আবার বক্তৃতা করলেন।
কারমাইকেলে অবস্থান কালীন সময়ে এই শিক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার যে সংগঠনগুলো আছে, এগুলোর সাথে স্যার সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। রক্তচক্ষুর লোলুপ দৃষ্টি থেকে সংগঠনগুলোকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছেন... এবং সফলও হয়েছেন সম্মিলিত প্রয়াসে।
সবমিলিয়ে ড. মোস্তাফিজার রহমান স্যারকে দেখেছি একজন আদর্শবান মানুষ, এবং দায়িত্বশীল শিক্ষক হিসেবে। একজন শিক্ষকের দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের মাঝে শেখার স্পৃহা জাগিয়ে দেয়া। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে মোস্তাফিজার রহমান স্যার শতভাগ সফল।